nikola tesla biography -বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলার জীবনী
বিখ্যাত বিজ্ঞানী শব্দটি শোনামাত্রই বেশিরভাগ সময় আমাদের মনজগৎ এ যে নাম গুলো ভেসে উঠে সেগুলো হচ্ছে আইজাক নিউটন,আলবার্ট আইনস্টাইন,থমাস আলভা এডিসন,মার্কনী,গ্যালিলিও প্রভৃতি।কিন্তু অনেকাংশেই এদের চেয়ে অবদান কম না রাখার সত্বেও ইতিহাসে ঝাপসা হয়ে থাকা এক বিজ্ঞানীর নাম নিকোলা টেসলা।ইলন মাস্ক এর বিখ্যাত ইলেক্ট্রিক কার টেসলার নামটি বর্তমানে জনপ্রিয় না হলে হয়তো আমাদের মাঝে অনেকেরই মনে এই কিংবদন্তির জীবনী সম্পর্কে জানার আগ্রহ জন্মাতো না।চলুন এই বিজ্ঞানী এবং উদ্ভাবক “বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলার জীবনী” সম্পর্কে কিছুটা ধারনা নেয়া যাক।
বিজ্ঞানী নিকোল টেসলা সার্বিয়ায় (বর্তমানে ক্রোয়েশিয়া)১০ ই জুলাই ১৮৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন।তার বাবার নাম মিলুটিন টেসলা এবং মায়ের নাম ডুকা ম্যান্ডিক।বলা হয়ে থাকে যে টেসলা যেদিন জন্মেছিলেন ওই দিন প্রচন্ড বজ্রপাত এবং ঝড় হয়েছিলো,তাই ধাত্রী সদ্যোজাত টেসলাকে অন্ধকারের শিশু বলে মন্তব্য করেছিলেন। এই মন্তব্যের জবাবে তার মা বলেছিলেন- ‘এই ছেলেই পৃথিবীতে আলো নিয়ে আসবে’।টেসলা তার পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে চতুর্থ ছিলেন। টেসলার বাবা পেশায় ছিলেন একজন ধর্মযাজক এবং তার মা পেশায় ছিলেন একজন গৃহিণী। টেসলার বাবা টেসলাকে ধর্মযাজকই বানাতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার আগ্রহ ছিলো ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রতি।গৃহিণী হবার সত্বেও টেসলার মা অবসর সময়ে বিভিন্নরকম গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি বানানোয় দক্ষ ছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই টেসলার বিভিন্নরকম প্রতিভা প্রকাশ পেতে থাকে। টেসলা ক্যালকুলাস এর ইন্টিগ্রেসন মনে মনেই সমাধান করে ফেলতে পারতেন, যা দেখে তার শিক্ষকদের মনে সন্দেহ হতে থাকে যে তিনি চিটিং করছেন।তিনি খুব সহজেই যেকোন তথ্য মনে রাখতে পারতেন। টেসলা ১৮৬১ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন।তিনি তাঁর মাধ্যমিক শিক্ষার চার বছরের পড়ালেখা তিন বছরেই শেষ করেফেলেন।মাধ্যমিক এর গন্ডি পার করার পর পরই তিনি কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন।তিনি এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েন যে তার বাবা মা ভাবতে থাকেন যে তিনি হয়তো আর বাঁচবেনইনা।তার এই শোচনীয় অবস্থায় তিনি বাবার কাছে আবদার করেন যে তিনি যদি সুস্থ হন তবে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ালেখা করবেন।ছেলের এই শোচনীয় অবস্থায় করা আবদার বাবা অনেকটা বাধ্য হয়েই মেনে নেন।টেসলা ঠিকি সুস্থ হয়ে ওঠেন।
১৮৭৪ সালে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ফলে চাকুরির স্বার্থে তাকে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়।এর এক বছর পরেই ১৮৭৫ সালে টেসলা সেনাবাহিনী হতে একটি বৃত্তি অর্জন করেন যার সাহায্যে তিনি অস্ট্রিয়ায় অবস্থিত গ্রাজ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করার সুযোগ পান। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কালে প্রথম বর্ষে তিনি প্রতিটি ক্লাসেই শতভাগ উপস্থিত ছিলেন।তিনি পড়ালেখায় মাত্রাতিরিক্ত শ্রম দিতে থাকেন।ফলে তিনি প্রথম বর্ষের ফলাফলে সব বিষয়েই সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে পাশ করেছিলেন। ইউনিভার্সিটির প্রধান টেসলার বাবাকে ছেলের ভাল ফলাফলের খবর জানিয়ে ছিঠি লিখে পাঠান। টেসলার বাবা প্রতুত্তরে একটি চিঠি পাঠান যাতে লেখা ছিল যে টেসলা হয়ত অধিক পরিশ্রম করলে মারা যেতে পারে,তাই অধিক পরিশ্রম করলে তাকে যেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে দেয়া হয়।টেসলা দ্বিতীয় বর্ষে উঠার পর ডিসি মোটরের( DC Motor ) কিছু সম্ভাব্য ত্রুটি নিয়ে শিক্ষকের সাথে তুমুল তর্কে জড়িয়ে পড়েন।সেই সাথে একই বছর জুয়াখেলার প্রতি তিনি দারুন ভাবে আসক্ত হয়ে পড়েন।এতে করে টেসলার বৃত্তি বাতিল হয়ে যায়।তিনি জুয়ার আসক্তি তে এতটাই বিভোর হয়ে যান যে তার শিক্ষা জীবন অসমাপ্ত অবস্থায় ই সমাপ্ত হয়ে যায়।
এর পর তিনি ১৮৭৮ সালের ডিসেম্বরে পরিবারকে না জানিয়েই স্লোভেনিয়াতে চলে যান।তিনি তার শিক্ষা জীবন এর সমাপ্তির কথা পরিবারকে জানাননি।স্লোভেনিয়াতে তিনি খুবি অল্প অর্থের বিনিময়ে ড্রাফটস ম্যানের চাকরি করতেন।তখন তিনি অবসর সময় তাস খেলেই কাটিয়ে দিতেন।এর পর তিনি ১৮৮১ সালে বুদাপেস্টে চলে যান।বুদাপেস্টে তিনি একটি টেলিফোন কোম্পানিতে কাজ পান। বুদাপেস্টে থাকাকালীন সময়ে একদিন পার্কে তাঁর এক বন্ধুর সাথে গল্প করার সময় হঠাৎ করেই লাঠি দিয়ে মাটিতে ইন্ডাকশন মোটরের( Induction Motor ) ডায়াগ্রাম এঁকেফেলেন।এর কিছুদিন পরেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন আমেরিকা চলে যাবেন।সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি ১৮৮৪ সালের জুন মাসে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে রওনা হন।তিনি নিউইয়র্ক এ যখন পৌছালেন তখন সম্পদ বলতে তার কাছে ছিলো মাত্র চার সেন্ট।কিন্তু তার উদ্দেশ্যে ছিলো বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের কোম্পানিতে চাকরি নেয়া।টেসলার কাছে তখন এডিসনে কোম্পানির একজন প্রাক্তন কর্মকর্তার রিকমেন্ডেশন লেটার ছিল যাতে লেখা ছিল যে,”প্রিয় এডিসন,আমি দুইজন বিখ্যাত ব্যাক্তিকে চিনি যার একজন হল তুমি আর একজন হল তোমার সামনে দাড়িয়ে থাকা এই যুবক”।এটি দেখার পর এডিসন টেসলাকে তার কোম্পানিতে চাকরি দিলেন। এডিসন টেসলাকে নিয়োগ দেয়ার কিছুদিন পরে তাকে বলেন যে তুমি যদি আমার ডিসি জেনারেটর প্রজেক্ট টি সম্পন্ন করতে পারো তবে তোমাকে আমি নগদ পঞ্চাশ হাজার ডলার দিবো।
টেসলা তার মেধা এবং শ্রম কাজে লাগিয়ে কিছুদিনের মাঝেই ডিসি জেনারেটর প্রজেক্ট টি সম্পন্ন করে ফেলেন। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে তখন যখন টেসলা তার পঞ্চাশ হাজার ডলার পাওনা এডিসন এর কাছে চাইলেন।এডিসন পাওনা তো দিলেনইনা উল্টো ঠাট্টা করে বলেন যে,”তুমি তো দেখি আমেরিকার হিউমারও বোঝ না”।টেসলা সাথে সাথেই এডিসনের চাকরি ছেড়েদিলেন।তিনি তার নিজের একটি কোম্পানি খুলে বসলেন।টেসলার কোম্পানির প্রথম উদ্ভাবন ছিলো কমুটেটর। এটিই ছিল তার করা প্রথম পেটেন্ট। কিন্তু টেসলার সেই উদ্ভাবনগুলোকে খুব একটা লাভজনক মনে করতোনা বিনিয়োগ কারিরা।ফলে বিনিয়োগ এর অভাবে টেসলা কোম্পানি ছেড়ে আবার চাকরির সন্ধানে নামেন।টেসলার দেওয়া এসি মোটর ধারনা অনেক বিনিয়োগ কারির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়।
pic Tesla AC generator
ফলে অনেকেই এটির উপর বিনিয়োগে আগ্রহ দেখায়।এতেকরে একটি কোম্পানি টেসলাকে এসি মোটর নিয়ে গবেষণা করার জন্য তাদের ল্যাবে নিয়জিত করে।এখানে উল্লেখ যে ল্যাবটি এডিসনের অফিসের পাসেই ছিলো। এর পর ১৮৮৮ সালে পৃথিবী পাল্টেদেয়া এসি কারেন্ট( AC Current) আবিষ্কার করতে সক্ষম হন বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলা। পরবর্তী তে টেসলা ষাট হাজার ডলারের বিনিময়ে এসি কারেন্ট এর পেটেন্ট করিয়ে নেন।খুবি দ্রুত চারিদিকে এসি কারেন্ট এর সুনাম এবং ব্যবহার বাড়তে লাগলো।এতেকরে এডিসন খুবি ভয় পেয়েগেলেন পাচে তার ডিসি কারেন্ট ব্যাবসা যদি লস এর সম্মুখীন হয়।তিনি জনসাধারণের মনে এসি কারেন্ট বিপদজনক এই ধারনাটি গেঁথেদিতে উঠেপড়ে লাগেন।এডিসন স্থানীয় ছেলেদের কে অর্থ দিতেন রাস্তার কুকুর-বিড়াল সংগ্রহ করার জন্য।এই কারেন্ট বিপদজনক এটি বুঝতে তিনি এই সকল প্রানিকে এসি কারেন্ট এর সক দিয়ে জনসম্মুখে হত্যা করতেন।
কথিত আছে তিনি নাকি এই ভাবে হাঁতী পর্যন্ত হত্যা করেছেন।এসি কারেন্ট টেসলার প্রকাশ পাওয়া আবিষ্কার গুলোর একটা মাত্র।অনেকেই মনে করেন টেসলার অনেক আবিষ্কার প্রকাশ হতে দেওয়া হয়নি বা মানবাতার বৃহৎ স্বার্থে তার মৃত্যুর পর সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তিনি আরো নানা কিছু আবিষ্কার করেছেন।বিংশ শতাব্দীর আগেই টেসলা একটি শক্তিশালী কয়েল উদ্ভাবন করেন।এই কয়েল এর সাহায্যে হাই ভোল্টেজ আর্ক ও ফ্রিকোয়েন্সী উৎপাদন করা যেতো।এটি “টেসলা কয়েল” নামে পরিচিতি পায়।
pic Tesla Coil
টেসলা বুঝতে পারেন যে তার এই আবিষ্কার বেতার তরংগ পাঠাতে এবং গ্রহন করতে পারে।কিন্তু তিনি এই বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্ব দেননি।তিনি ভাবতেন এগুলো সহজ বিষয়,সবাই জানার কথা।বিষয় টি মারকনি বুঝতে পেরে রেডিও প্রযুক্তির পেটেন্ট করিয়ে নেয়।এতে করে তিনিই রেডিওর জনক হিসেবে পরিচিতি পান।নিকোলা টেসলা এক্স রে তরঙ্গও অনেক আগেই পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।কিন্তু রেডিওর মতই তিনি কোন পেটেন্ট নেন নি।পরবর্তীতে রনঞ্জেন্ট এই তরঙ্গ কে এক্স রে নাম দেন।বর্তমানের রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইস এবং ওয়াই-ফাই প্রযুক্তি ও টেসলার অবদান।
টেসলার অনেক আবিষ্কার আছে যেগুলো তিনি পেটেন্ট করেন নি আবার কিছু আবিষ্কার তিনি মানবতার স্বার্থে নিজ হাতেই ধ্বংস করে দিয়েছেন।
টেসলার কিছু আবিষ্কার নিচে উল্লেখ করাহলোঃ
টেসলা কয়েল
ইন্ডাকশন মোটর
এসি কারেন্ট
রিমোট কন্ট্রোল
থ্রি পাশ ইলেক্ট্রিক পাওয়ার
টেসলা টারবাইন
টেসলা ভালব
টেলিফোর্স
টেসলা ওক্সিলেটর
টেলিজিওডাইনামিকস
ভায়লেট রে
নিয়ন ল্যাম্প
ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি
ভ্যাকুয়াম ভেরিয়েবল ক্যাপাসিটর
টেসলা চেয়েছিলেন পুরো পৃথিবীকে বিনামূল্যে তারবিহিন বিদ্যুৎ দিতে।কিন্তু কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের কারনে তার এই প্রজেক্ট সফল হয়নি।
pic Tesla free Energy
উল্টো তিনি প্রচুর পরিমাণে ঋণগ্রস্ত হয়েযান।
মানবিকতার স্বার্থে কাজ করা এই মহান বিজ্ঞানীর শেষ জীবন অর্থাভাবে খুবি দুর্দশায় কাটে।তিনি “দি নিউইয়র্ক হোটেল” নামের একটি হোটেলে তার জীবনের শেষ দিন গুলো কাটিয়েছেন। নিকোলা টেসলা তার শেষ বয়সে অবসেসিব কমপালসিব ডিসঅর্ডার নামে এক রোগে আক্রান্ত হন।কিন্তু তখনও তিনি তার ফ্রি ওয়ারলেস এনার্জি নিয়ে কাজ করছিলেন।পরে যে কোম্পানি কাজটি করছিলেন তারা আর্থিক ভাবে লাভবান না হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে কাজটি বন্ধ করে দেয়।ইতিহাসের পাতায় ঝাপসা হতে থাকা এই মহান বিজ্ঞানী ও উদ্ভাবক কে ১৯৪৩ সালের ৭ই জানুয়ারি মৃত অবস্থায় দি নিউইয়র্ক হোটেল এর ৩৩২৭ নং কক্ষে পাওয়াযায়।